বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৩ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
মহামারীতেও ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিলের খড়্গ

মহামারীতেও ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিলের খড়্গ

করোনাকালীন তিন মাস গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল আদায়ে শিথিল ছিল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো। এ সময় বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির বিল আদায় হয়েছে গড়ে ৩৫ শতাংশ। ফলে বিরাট অঙ্কের এ রাজস্ব আদায় সংকটে পড়েছে সরকার। বিদ্যুৎ বিল ঠিকমতো আদায় না হওয়ায় সরকারের বিদ্যুৎ খাতে আর্থিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। এখন হঠাৎ বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো বিল আদায়ে তৎপর ও কঠোর হওয়ায় দেখা দিয়েছে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা।

বিদ্যুৎ বিল নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ ও ক্ষোভের সীমা নেই। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় বিলম্ব বিদ্যুৎ বিলের সারচার্জ মওকুফ করে যে প্রশংসা কুড়িয়েছিল, বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর খামখেয়ালি বিল করে গ্রাহকদের দেওয়ায় সেটা ম্লান হতে চলেছে।

গ্রাহকদের অভিযোগ, মিটার রিডিং না দেখে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কয়েকগুণ বেশি বিল দেওয়া হয়েছে গ্রাহকদের। ফলে ঈদের আগে নানাভাবে বিপর্যস্ত এবং আর্থিক সংকটে থাকা মানুষ হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

বিষয়টি নিয়ে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ানের সঙ্গে কথা বললে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ডিপিডিসির বিদ্যুৎ বিতরণ এলাকায় করোনার প্রভাব ছিল

সবচেয়ে বেশি। অধিকাংশ এলাকা লকডাউন হয়ে পড়েছে। ফলে মিটার রিডাররা রিডিং নিতে পারেনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে। ফলে ইস্টিমিটেড বিল দিয়েছে গ্রাহকদের। সেক্ষেত্রে বিলে কম-বেশি হতে পারে। তিনি বলেন, তবে কোনো গ্রাহক যদি অভিযোগ করে সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোকে নির্দেশ দেওয়া আছে সেটা সংশোধন করে দিতে। এছাড়া বিলে যদি কম-বেশি হয়ে থাকে সেটা পরবর্তী সময়ে মিটার দেখে সংশোধন করে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

এই মুহূর্তে বিল আদায়ে এতটা তৎপর কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিপিডিসি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে বিদ্যুৎ কিনে তবে বিক্রি করে। স্বাভাবিক সময়ে ডিপিডিসির বিদ্যুৎ বিল আদায় হয় প্রায় সাড়ে চারশ কোটি টাকা। করোনাকালীন বিল আদায় হয়েছে মাত্র ৩৫ শতাংশ। ফলে ডিপিডিসির কাছে পাওনা পিডিবির বিদ্যুৎ বিল জমা হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পিডিবি বেসরকারি মালিকদের কাছ থেকে কেনা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে পুরো প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, নিয়মিত বিল আদায় করা ছাড়া উপায় নেই।

বিদ্যুৎ বিল নিয়ে গ্রাহকদের কোনো অভিযোগ আছে কিনা জানতে গতকাল এ প্রতিবেদক সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে একটি একটি পোস্ট করে গ্রাহকদের অভিযোগ ইনবক্সে জানাতে বলেন। পরে দেশে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ তাদের অতিরিক্ত বিল দেওয়ার অভিযোগ করেন। নারায়ণগঞ্জের চানমারি থেকে সাংবাদিক ইশতিয়াক আহমেদ অভিযোগ করেন তাদের সব সময় বিল আসে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। কিন্তু তাদের গত মাসের বিল দেওয়া হয়েছে ২৪ হাজার টাকা।

ফতুল্লার তক্কার মাঠ এলাকা থেকে রেদওয়ান নামে একজন অভিযোগ করে বলেন গত মাসে তারা কোনা বিদ্যুৎই ব্যবহার করেননি। তাদের ঘর তালামারা ছিল। তবু তাদের বিল দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৯৩৭ টাকা।

ঢাকা ওয়াসার এক কর্মকর্তা আব্দুল কাদের মুন্না অভিযোগ করেন, আমি ডেসকোর রূপনগর অফিসের গ্রাহক। ডেসকোর অ্যাপ ব্যবহার করে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বিল পরিশোধ করি। আমার কোনো বিল বাকি নেই। গত বৃহস্পতিবার আমার মোবাইলে দুটি অ্যামাউন্টের বিল কেটে নেয়, তাও সেটা ডেসকো খিলক্ষেত অফিসের নামে।

কাদের বলেন, আমি কার্ড কল সেন্টারে ফোন করলে তারা বলে আমি যদি অ্যাপে তথ্য দিয়ে কেটে নেওয়ার অনুমতি দিই, তবেই তারা কেটে নিবে। কিন্তু আমি কাউকে এমন অনুমতি দিইনি। আমি রূপনগরের গ্রাহক বিল কেটে নিয়েছে খিলক্ষেত অফিস। এখন আমি রূপনগর অফিসে যোগাযোগ করলে তারা মেসেজসহ মেইল করতে বলে। আমি করেছি কিন্তু এখনো কোনো প্রতিকার পাইনি।

সাংবাদিক আরাফাত দাড়িয়া থাকেন জিগাতলা। তিনি বলেন, তার এই মাসে অন্তত চার হাজার টাকা বেশি বিদ্যুৎ বিল দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের এক গ্রাহক স্বপন আহমেদ বলেন আমার মিটার বন্ধ। তবু ১৬ হাজার ৭০০ টাকার বিল দিয়েছে।

আবার অনেকে অনলাইনে বিল পরিশোধ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন। তিতাস গ্যাসে চাকরি করেন মোহাম্মদ জহির হোসেন। তিনি অভিযোগ করেন আমার গ্রাহক আইডি ২৯০৯৪২৩৮। ফেব্রুয়ারি মাসে বিল পরিশোধ করেছি। বর্তমানে এপ্রিল মাসের বিলের সঙ্গে ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে বিল যুক্ত হয়ে আসায় বিল পরিশোধ করতে পারছি না। সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম রনি অভিযোগ করেন, তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার চকরসুল্লাহ গ্রামে। সেখানে তাদের পরিবারসহ অনেকের বাড়িতে তিন-চারগুণ বিল ধরিয়ে দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, তিনি মান্ডা এলাকায় অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেনের বাড়িতে ভাড়া থাকেন। তার ব্যবহৃত বিদ্যুৎ সর্বনি¤œ ইউনিট হলেও বাড়িওয়ালা তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৭/৮ টাকা ইউনিট বিল আদায় করছে।

তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিল কম দেওয়ারও অভিযোগ আছে। কৃষি ব্যাংকের অফিসার মিজানুর রহমান অভিযোগ করেন তাদের বিল সাধারণত ১২শ থেকে ১৫শ, সর্ব্বোচ্চ দুই হাজার পর্যন্ত আসে। কিন্তু গত তিন মাস তাদের গড়ে বিদ্যুৎ বিল দেওয়া হচ্ছে ৯০ টাকা করে। মিজান অভিযোগ করেন, এখন কম টাকা বিল দিলেও পরে নিশ্চয় জমে থাকা বিদ্যুৎ ইউনিট দেখে একসঙ্গে বেশি ইউনিট ধরে বিল দিবে। তখন তো ক্ষতিগ্রস্ত হব।

রাজধানীর ৬৪, গ্রিন রোড, আরবান দিগন্ত এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী সুচিতা দামাই অভিযোগ করেন, তাদের গড়ে বিদ্যুৎ বিল আসে এগারো থেকে বারশ টাকা। কিন্তু এই মাসে তাদের বিল দেওয়া হয়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকা।

তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রাহকের দুই মাসের বিদ্যুৎ বিল একসঙ্গে করে মোবাইলে এসএমএস যাওয়ায় গ্রাহকরা মনে করছেন বেশি বিদ্যুৎ বিল দেওয়া হয়েছে। যখন তারা বুঝতে পারছেন তাদের বকেয়া বিল সঙ্গে যুক্ত করে এক সঙ্গে দেওয়া হয়েছে তখন বিষয়টি মেনে নিচ্ছেন। তবে অধিকাংশ গ্রাহকেরই কয়েকগুণ বেশি বিদ্যুৎ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে দেশের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সমিতিগুলো বিদ্যুৎ বিল আদায়ে বেশি কঠোর হয়েছেন। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জোনাল অফিস থেকে মাইকিং করে বলা হয়েছে বিল পরিশোধ না করলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে।

এদিকে বিল আদায় নিয়ে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন (অব) আমাদের সময়কে বলেন, গত পরশু দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে এগারো হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। যার মধ্যে পল্লী বিদ্যুৎ একাই সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। করোনায় গ্রাহকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিদ্যুৎ বিল সংগ্রহ করা না গেলেও আমরা গত বছরের মার্চ-এপ্রিলের বিলকে ধরে গড়ে এ বছর বিল দিয়েছি।

সেই ক্ষেত্রে গ্রাহকদের বেশি হওয়ার কথা নয়। কারণ গত বছরের তুলনায় এ বছর গ্রাহকদের বিদ্যুৎ ব্যবহার বেশি হওয়ার কথা। তিনি বলেন, গড়ে পল্লী বিদ্যুৎ মাসে ২০০ কোটি টাকার বিল আদায় করে। সেখানে এখন গড়ে ৩৫ শতাংশ বিল আদায় হচ্ছে। তিনি বলেন, গ্রাহকের বিল আদায় না করলে সংকটে পড়বে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো।

এদিকে রংপুর অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পনি নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাকিউল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, মার্চ মাসে নেসকো ৫০ শতাংশ বিল আদায় করতে পেরেছে। তবে এ মাসে বিল কিন্তু পরের মাসগুলোয় বিল আদায় অনেক কম। ব্যাংক বন্ধ থাকায় এবং অধিকাংশ মানুষের ইন্টারনেট অ্যাকসেস বা অনলাইন বিল পরিশোধ করার আগ্রহ না থাকায় বিল কম আদায় হচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষের কাছ থেকে বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায় করা কঠিন। তবে তিনি বলেন, তার বিতরণ এলাকায় গ্রাহকদের বেশি বিল দেওয়ার তেমন অভিযোগ নেই।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877